ভাষা আন্দোলন
ভাষা আন্দোলন

ভাষা আন্দোলন

ভাষা আন্দোলন এর ইতিহাস জানতে আমাদের ফিরে দেখতে হবে ১৯৫২ এর পূর্বের ইতিহাস। বাংলাকে তৎকালীন পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে পূর্ববঙ্গে গড়ে উঠেছিল ভাষা আন্দোলন । বাঙালির জাতীয় চেতনা – যা পরে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার আন্দোলনে

পরিণত হয় । ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার ৫৬.৪০% লোকের মুখের ভাষা ছিল বাংলা। পাকিস্তানের মাত্র ৩.২৭ % লোকের মুখের ভাষা ছিল উর্দু। এমতাবস্থায় ভারত বিভাগের পর পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কি হবে তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেয়। চৌধুরী খলীকুজ্জমান এবং আলীনগর বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য জিয়াউদ্দিন আহমদ উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব  দেন। তাদের প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভাষাবিজ্ঞানী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপক ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ এবং মোহাম্মদ এনামুল হক বুদ্ধিজীবী প্রতিবাদ জানান। এ সময়ে একটি ভাষণে ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছিলেন “আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য তার চেয়ে বেশি সত্য আমরা  বাঙালি”।

সাল ১৯৪৭ –

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবুল কাসেমের নেতৃত্বে “তমুদ্দুন মজলিশ” নামে একটি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে ২রা সেপ্টেম্বর ১৯৪৭ ।পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে চালু করার দাবি নিয়ে এগিয়ে আসে “তমুদ্দুন মজলিশ”। এটি ছিল ভাষা আন্দোলন এর প্রথম  সংগঠন।

তমুদ্দিন মজলিস ভাষা আন্দোলন এর প্রথম পুস্তিকা পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু প্রকাশ করা হয় ১৫ সেপ্টেম্বর ১৯৪৭। পুস্তিকার লেখক ছিলেন তিনজন অধ্যাপক আবুল কাশেম কাজী মোতাহার হোসেন এবং আবুল মনসুর আহমদ।

ডিসেম্বরে তমুদ্দিন মজলিস এর উদ্যোগে ভাষা আন্দোলন কে রাজনৈতিক রূপদানের জন্য গঠিত হয় প্রথম “রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ”, যার  আহ্বায়ক নির্বাচিত হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নূরুল হক ভূঁইয়া। 

সাল ১৯৪৮ –

ফেব্রুয়ারী –

২৩ শে ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান পরিষদ অধিবেশন ইংরেজি পাশাপাশি অধিবেশনের কার্যক্রম শুরু হলে পূর্ববাংলার গণপরিষদ সদস্য কুমিল্লার এর প্রতিবাদ করেন এবং বাংলা ভাষাকে গণপরিষদের অন্যতম সরকারি স্বীকৃতির দাবি জানান। কিন্তু গণপরিষদে দাবি প্রত্যাখ্যান করলে পূর্ববাংলার ছাত্র-শিক্ষক ও বুদ্ধিজীবী মহল অসন্তোষ দেখা দেয়।


মার্চ –

২ রা মার্চ রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ কে পুনর্গঠন করে কামরুদ্দীন আহমদ এর সভাপতিত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়।

১১ ই মার্চ রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ রাষ্ট্রভাষার ক্ষেত্রে সরকারের ষড়যন্ত্র করার জন্য সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দেয়। ঐ দিন ঢাকায় বহু ছাত্র আহত হয় এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার হন। ১৯৪২-৫২ সালের ভাষা আন্দোলন এর সময়কাল প্রতি বছর ১১ মার্চ “ভাষা দিবস” ( Language Day ) হিসেবে পালন করা হত।

২১শে মার্চ মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকা তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে এক জনসভায় ঘোষণা দেন  “উর্দু এবং একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা”।

২৪শে মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে একই কথার পুনরাবৃত্তি করলে উপস্থিত ছাত্র নানা না বলে তীব্র প্রতিবাদ জানান।


সাল ১৯৪৯ –

পূর্ব বাংলার বাংলা ভাষা সংস্কারের নামে “পূর্ব বাংলা ভাষা” কমিটি গঠন করে ১৯ সদস্য বিশিষ্ট কমিটির সভাপতি ছিলেন মাওলানা আকরাম খাঁ।


 সাল ১৯৫০ –

পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান ঘোষণা করেন “উর্দু-ই পাকিস্তানের জাতীয় ভাষা” হবে।


সাল ১৯৫২ –

জানুয়ারি –

২৬ শে জানুয়ারি পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন ঢাকায় জনসভার ঘোষণা করেন “উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা”। সেইদিন আতাউর রহমান খানের সভাপতিত্বে কাজী গোলাম মাহবুবকে আহ্বায়ক করে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয়।

৩১ শে জানুয়ারি আওয়ামী লীগের সভাপতি মাওলানা হাসানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দলের সভায় সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়।  যার আহ্বায়ক ছিলেন কাজী গোলাম মাহবুব। সংগ্রাম পরিষদ একুশে ফেব্রুয়ারি ( ৮ই ফাল্গুন ১৩৫৮ )  রোজ বৃহস্পতিবার “রাষ্ট্রভাষা  দিবস” পালনের সিদ্ধান্ত নেয়ায় এবং সারাদেশে হরতাল কর্মসূচি পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।


ফেব্রুয়ারি –

২০ শে ফেব্রুয়ারি ছাত্র আন্দোলনের ভয়ে ভীত হয়ে নুরুল আমিন সরকার ১৪৪ ধারা জারি করে এবং সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করে।

২১ শে ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা সংগঠিতভাবে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে “রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই” স্লোগান দিতে দিতে বর্তমান ঢাকা মেডিকেল কলেজ চত্বরে সমাবেশ হয়। সোয়া এগারোটার দিকে ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয় গেটে জড়ো হয়ে প্রতিবন্ধকতা ভাঙার চেষ্টা করে। ছাত্রদের একটি দল ঢাকা মেডিকেল কলেজের দিকে দৌড় দেয় এবং বাকিরা পুলিশ পরিবেষ্টিত ক্যাম্পাসে মিছিল করে। সশস্ত্র পুলিশ বেষ্টিত ক্যাম্পাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং অন্যান্য কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। উপাচার্য পুলিশকে গুলি চালানো বন্ধ করতে এবং ছাত্রদেরকে এলাকা ছেড়ে চলে যাওয়ার আদেশ দেন। ছাত্রদের চলে যাবার সময় পুলিশ ১৪৪ ধারা লঙ্ঘনের জন্য কিছু ছাত্রকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারের সংবাদ পেয়ে বিক্ষুব্ধ ছাত্ররা পূর্ব বাংলা গণপরিষদ অবরোধ করে সেখানে তাদের প্রস্তাব উপস্থাপনের দাবি জানায়। ছাত্রদের একটি দল বিল্ডিঙের মধ্যে দ্রুত ঢোকার চেষ্টাকালে পুলিশ উপস্থিত জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করলে ছাত্র-পুলিশ সংঘর্ষ বাধে। সেদিন মিছিলে অংশ নেয় রফিকউদ্দিন পুলিশের গুলিতে শহীদ হন। তিনি ভাষা আন্দোলনের প্রথম শহীদ । পুলিশের গুলিতে আরও  শহীদ হন  আবুল বরকত,  আব্দুস সালাম,  আব্দুল জব্বার, প্রমুখ।  ৯ বছরের শিশু ওহিউল্লাহও পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছিল। আবুল বরকত (ডাকনাম ছিলেন আবাই)  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র। হত্যাকাণ্ডের সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে সারা শহর জুড়ে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে।

২২ শে ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে শোভাযাত্রা বাইর হয়। এই প্রতিবাদ শোভাযাত্রাতেও  পুলিশ গুলিবর্ষণ করে। ঐ দিন শহিদ হন শফিউর রহমান।


ভাষা আন্দোলনের শহীদ স্মৃতিকে অম্লান করে রাখার জন্য মেডিকেল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে রাতারাতি ছাত্রদের দ্বারা গড়ে ওঠে শহীদ মিনার, যা ২৪ ফেব্রুয়ারি উদ্বোধন করেন শহীদ শফিউর রহমানের পিতা। ২৬ ফেব্রুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে শহীদ মিনারের উদ্বোধন করেন দৈনিক আজাদ পত্রিকার সম্পাদক জনাব আবুল কালাম শামসুদ্দীন


১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সময় –

পদবী নাম
গভর্নর জেনারেলমালিক গোলাম মোহাম্মাদ
প্রধান মন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন
বাংলাদেশের মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন

শহিদ দিবস –

১৯৫৩ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি দেশব্যাপী “শহীদ দিবস” হিসেবে পালিত হয়। পরবর্তীতে প্রতি বছর ২১ ফেব্রুয়ারি তারিখে মহান ভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানানো হয়।  ২০০১ সাল থেকে দিবসটি উদযাপিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে।

শহীদ মিনার –

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্ররা, ২৩ ফেব্রুয়ারি রাতে শহীদ মিনার তৈরির কাজ শুরু করে এবং শেষ হয় ২৪ তারিখ ভোরে। তাতে একটি হাতে লেখা কাগজ গেঁথে দেয়া হয়, যাতে লেখা ছিল শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ। ঐ দিনই শহীদ মিনার নির্মাণের খবর দৈনিক সংবাদপত্রগুলোতে পাঠানো হয় । শহীদ বীরের স্মৃতিতে – এই শিরোনামে দৈনিক আজাদ পত্রিকায় ছাপা হয় শহীদ মিনারের খবর

শহীদ মিনারটি ছিল ১০ ফুট উচু আর ৬ ফুট চওড়া। মিনার তৈরির তদারকিতে ছিলেন জিএস শরফুদ্দিন (ইঞ্জিনিয়ার শরফুদ্দিন নামে পরিচিত), নকশা অঙ্কন করেছিলেন বদিউল আলম। তাদের সাথে ছিলেন সাঈদ হায়দার। শহীদ মিনার নির্মাণে সহযোগিতা করেন দুইজন রাজমিস্ত্রী। মেডিক্যাল কলেজের সম্প্রসারণের জন্য জমিয়ে রাখা ইট, বালু এবং পুরনো ঢাকার পিয়ারু সর্দারের গুদাম থেকে সিমেন্ট আনা হয়। ভোর হবার পর একটি কাপড় দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয় মিনারটি। ঐ দিনই অর্থাৎ ২৪ ফেব্রুয়ারি সকালে, শহীদ শফিউরের পিতা অনানুষ্ঠানিকভাবে শহীদ মিনারের উদ্বোধন করেন। উদ্বোধনের দিন অর্থাৎ ২৬ ফেব্রুয়ারি পুলিশ ও পাকিস্তান সেনাবাহিনী মেডিক্যালের ছাত্রদের আবাসিক হোস্টেল ঘিরে ফেলে এবং প্রথম শহীদ মিনার ভেঙে ফেলে। এরপর ঢাকা কলেজেও একটি শহীদ মিনার তৈরি করা হয়, এটিও একসময় সরকারের নির্দেশে ভেঙে ফেলা হয়।

একুশের গান –

২১ ফেব্রুয়ারি গুলিবর্ষণের ঘটনার পর ‘একুশ’ নিয়ে প্রথম গান আবদুল গাফফার চৌধুরী;- গানটি হল –

আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি।

এ গানটিতে প্রথমে সুরারোপ করেন আব্দুল লতিফ। পরে করাচী থেকে ঢাকা ফিরে ১৯৫৪ সালে আলতাফ মাহমুদ আবার নতুন করে সুরারোপ করেন। সেই থেকে ওটা হয়ে গেল একুশের প্রভাতফেরীর গান।

বর্তমানে আলতাফ মাহমুদের সুর করা গানটিই গাওয়া হয়। ১৯৫৪ সালে হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত একুশে সংকলনে প্রকাশিত হয় গানটি। তৎকালীন সরকার সংকলনটি বাজেয়াপ্ত করে। জহির রায়হান তার জীবন থেকে নেয়া ছবিতে এ গানটি ব্যবহার করার পর এর জনপ্রিয়তা ব্যাপকতা লাভ করে। ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পাবার পর আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে এই গানটির সুনাম আরো বাড়তে শুরু করে। ইতোমধ্যে গানটি সুইডিশ ও জাপানি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। বিবিসি শ্রোতা জরিপে বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ গানের তালিকায় এটি তৃতীয় স্থান লাভ করেছে।


তথ্যসূত্রঃ

জ্ঞানগৃহ এর নিজস্ব লেখকগন।

Leave a Reply